চেয়ারম্যানকে গণধোলাই, ক্ষোভে থানায় আটক নিরপরাধ ৪ ব্যক্তি
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নে গণধোলাইয়ের শিকার হন স্থানীয় চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন সোহেল। কিন্তু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইভটিজিংয়ের মামলায় সেনবাগ থানায় আটক রয়েছেন নিরপরাধ ৪ ব্যক্তি।
জানা যায়, চেয়ারম্যান গণধোলাই খেয়েছে এমন খবর শুনে উৎসুক হয়ে ঐ অঞ্চলে প্রবেশের পথে আটক করা হয় এক সিএনজি চালকসহ ৩ কিশোরকে। দরিদ্র পরিবারের সদস্য সেই সিএনজি চালক সদ্য কিশোর বয়স পার করেছেন বলে জানায় তার পরিবার।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, একটি সিএনজির ওপর নির্ভর করে তাদের পরিবারের সকল আয়। এই ছেলেকে আটকের পাশাপাশি সিএনজিটিও থানায় জমা রয়েছে। ফলে মানুষের বাসায় খাবারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে সিএনজি কেনার জন্য ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে শোধ করতে পারছে না সেই কিস্তি। ফলে থানা থেকে সিএনজি ফেরত পেলেও পরিবারটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে এ ঘটনায় আটক রমজান আলী টিপুর মা ফোনে জানান, ‘মারামারি হয়েছে বিকেলে কী তার একটু আগে, চারটার দিকে। আর আমার ছেলে সে সময় আমাদের এখানের মাঠে ফুটবল খেলেছে। খেলা শেষে মারামারি হয়েছে শুনে তারা কয়েকজন ঐ এলাকায় ঢোকার মুখে তাদের আটকে দেওয়া হয়। এরপর তো থানায় নিয়ে শুনেছি মারধরও করা হয়েছে। আমাদের গ্রামে মাঠে উপস্থিত সবাই জানে, ওরা মারামারির সময় কোথায় ছিলো।’
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, রমজান আলী টিপু রং মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করেন।
মামলার ৭ নম্বর আসামী আবদুল গনি পারভেজ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে তার বাবার। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে এলাকায় নিরীহ হিসেবে পরিচিত। নিজের মত করে চলে। পুলিশ জানিয়েছে তাকে ধরে নিয়ে গেছে বাঁচানোর জন্য। না হলে স্থানীয় মানুষজন নাকি ঐ এলাকায় ঢোকার মুখে ওদের পিটিয়ে মেরে ফেলতো। পরে শুনেছি ইভটিজিং নাকি নারী নির্যাতন কী এক মামলার আসামী করে দিয়েছে। জিজ্ঞাস করেছিলাম, বাঁচানোর জন্য ধরলে মামলা দিলেন কেন? আমাকে বলল, চেয়ারম্যান সাহেব গণধোলাই খাইছে। এখন কাউরে ধরে এভাবে ছেড়ে দিলে সে রাগ করতে পারে। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা ছেড়ে দিবো।’
এই চারজন প্রসঙ্গে তাদের একাধিক প্রতিবেশী ও স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, পুলিশ যখন তাদের গ্রেপ্তার করে, তখন তাদের চার জনের কাছে কোন অস্ত্র ছিলো না। কিন্তু তাদের সঙ্গে দেশিয় অস্ত্র ও রড ছিলো এমন উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে।
এখানে আটক তিনজন মারামারির সময় অন্য স্থানে উপস্থিত ছিলো, এমন কথাও জানিয়েছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী।
এদিকে এ বিষয়ে গণধোলাইয়ের শিকার চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন সোহেলকে জিজ্ঞাস করা হলে প্রাথমিকভাবে তিনি জানান, এরা কিশোরগ্যাংয়ের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে থানা পুলিশ। ইভটিজিংয়ের সঙ্গে এরা জড়িত ছিলো। মারামারির সঙ্গেও জড়িত ছিলো।
পরবর্তীতে আবারো তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আসলে রাতে মারামারিতে কারা উপস্থিত ছিলো আমি জানি না। স্থানীয়রা তাদের ধরে আটক করেছে এবং পুলিশে দিয়েছে। কোনও জায়গায় বিশৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব আমার না, এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তবুও আমি গিয়েছিলাম দায়িত্ববোধ থেকে। বাকিটা আপনারা জানেন। রাতের আঁধারে আমি জানি না সেখানে কারা ছিলো। এরা যদি নির্দোষ হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ছেড়ে দেবে পুলিশ। আর দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি হবে।
কিন্তু পরিবার ও প্রতিবেশীরা দাবি করছে তারা নির্দোষ- এমন প্রসঙ্গ তুললে চেয়ারম্যান বলেন, আসলে কোনও পরিবার কি তার নিজ ছেলেদের দোষী বলবে। সবার ছেলেই নিজের কাছে ভালো। বাকিটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবে।
এদিকে থানায় আটক চারজন প্রসঙ্গে সেনবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী বলেন, তারা মারামারিতে সম্পৃক্ত ছিলো এমন তথ্যের ভিত্তিতেই আটক করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ইভটিজিংয়ের অভিযোগও করা হয়েছে। তদন্ত শেষে তারা নির্দোষ সাব্যস্ত হলে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে রিমান্ডের আবেদনও করেছি আমরা। এখনো তা মঞ্জুর হয়নি।
‘এই চারজন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য’- চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে উনি জানেন না কিশোর গ্যাং সম্পর্কে। এরা কেউই কিশোর না। সুতরাং কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে শুধু তদন্তের জন্য আর কতদিন এই চারজন কারাগারে থাকবে এ প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর মেলেনি কারো কাছে।