বাংলাদেশের ক্রিকেটে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের তালিকা করলে তাতে ‘সাকিব আল হাসানের ছুটি’ অবধারিতভাবেই ওপরের দিকে থাকবে। গত কয়েক বছরে এটাই রীতি হয়ে গেছে যে সাকিব কয় দিন পরপর এই সিরিজ ওই সিরিজ থেকে ছুটি চাইবেন। সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা–সমালোচনা হবে। তবে শেষ দৃশ্য একটাই—সাকিবের ছুটি মঞ্জুর।

 

এবারের ঘটনাপ্রবাহের শেষটাও সে রকমই হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান যদিও কাল কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন, অতীত কিন্তু নতুন কিছুর সম্ভাবনা বলছে না। বরং এবার সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা না যাওয়ার যে কারণ জানিয়েছেন, সেটি আগের সব বারের চেয়ে বেশি যৌক্তিক। একজন খেলোয়াড় যদি বলেন, তিনি খেলার মতো মানসিক ও শারীরিক অবস্থায় নেই, তাঁকে জোর করে কীভাবে মাঠে নামাবে বিসিবি? ভালো খেলার দায়বদ্ধতাও তো তখন আর সাকিবের থাকবে না!

 

 

পরশু রাতে দুবাই যাওয়ার আগে সাকিব বিমানবন্দরে বলেছেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে এখন যে অবস্থায় আছেন, তাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়া ঠিক হবে না বলেই তাঁর মনে হচ্ছে। তিনি সামর্থ্যের সবটুকু দিতে পারবেন না। আফগানিস্তান সিরিজটা তো উপভোগ করেনইনি, বরং দলে নিজেকে নাকি তাঁর মনে হয়েছে শুধুই একজন ‘প্যাসেঞ্জার’!

 

আইপিএলের নিলামের আগেই বিসিবিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে না যাওয়ার কথা বলেছিলেন সাকিব। কিন্তু নিলামে কোনো দল তাঁকে না নিলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। প্রথমে মৃদু আপত্তির পর শেষ পর্যন্ত বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাবেন বলেই জানিয়েছিলেন সাকিব। সে কারণেই তাঁকে রেখে দল ঘোষণা।

 

কিন্তু এখন সাকিবের মনে হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডে সিরিজটা না খেললে অবসাদ কাটিয়ে মানসিকভাবে চাঙা হওয়ার সুযোগ পাবেন। তখন টেস্ট সিরিজটা ঠিকঠাক খেলতে পারবেন। সাকিব এমনও বলেছেন, সেরা অবস্থানে না থেকেও দলের সঙ্গী হওয়াটা সতীর্থদের সঙ্গে প্রতারণা মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। নিজের মানসিক অবস্থা নিয়ে তিনি বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুসের সঙ্গেও কথা বলেছেন। জালাল ইউনুস সাকিবকে চিন্তা করার সময় দিয়েছেন। সাকিব দুবাই থেকে ফিরলে এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা।

 

তার মানে সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা যাবেন কি যাবেন না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াটা এখনো শেষ হয়নি। দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা হিসেবে বিসিবি যদি শেষ পর্যন্ত বলে, দলের স্বার্থে সাকিবকে যেতেই হবে, তিনি হয়তো যাবেন। কিন্তু সেই যাওয়াটা কেমন হবে, সেটি না বললেও চলছে। অস্ত্রোপচারের টেবিলে না হয় রোগীর ভালোর জন্যই রোগীকে জোর করে নেওয়া যায়, কিন্তু এটা তো খেলার মাঠ! খেলোয়াড়ের মধ্যেই যদি মাঠে নামার মানসিক শক্তি না থাকে, তিনি শারীরিকভাবে তৈরি না থাকেন, কী দিয়ে খেলবেন সেই খেলোয়াড়!

 

বিসিবি সভাপতি অবশ্য কাল তাঁর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাকিবের বলা কারণটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে সে আইপিএল খেলত কীভাবে? যদি ওকে আইপিএলে নিত, তাহলে বলত আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত?’ অর্থাৎ সাকিব যে কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যেতে চাইছেন না, সেটি তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।

 

কিন্তু দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা হিসেবে বিসিবির কাজ তো ক্রিকেটারদের সমালোচনা করা বা তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা নয়। প্রশ্ন থাকলেও সেটি এভাবে বাতাসে ছেড়ে না দিয়ে বিসিবির উচিত সাকিবের দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে না চাওয়ার আসল কারণটা খুঁজে বের করা। সাকিব কি সত্যিই শারীরিক–মানসিকভাবে ক্লান্ত, নাকি এখানে অন্য কোনো কারণ আছে? দক্ষিণ আফ্রিকা না গিয়ে এই সময়ে কী সাকিব পণ্যের বিজ্ঞাপন করে বেড়াবেন? কারও বদলি হিসেবে তাঁর আইপিএলে খেলার সম্ভাবনা আছে? নাকি এমন কিছু, যেটির খোলামেলা ব্যাখ্যা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই হয়ে দাঁড়াতে পারে স্পর্শকাতর!

 

সত্যি বলতে কি, আজ পর্যন্ত সাকিবের না খেলা এমন একটা সিরিজ দেখানো যাবে না, যেটাতে বিসিবির অনুমোদন ছিল না। কখনো পারিবারিক কারণে, কখনো বিদেশের লিগে খেলতে জাতীয় দলের খেলা থেকে ছুটি নিয়েছেন সাকিব। বিসিবি চাইলে পারত তখনই কঠোর হতে। অথবা যখন দেখা যাচ্ছিল এই প্রবণতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, তখনই ক্রিকেটারদের এ রকম ছুটিছাটার বিষয়গুলোকে কোনো নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসতে।

 

তা ছাড়া সাকিবের একটা কথার সঙ্গে বিসিবি সভাপতির কথারও মিল আছে। পরশু সাকিব যেমন বলেছেন, পুরো বছরের পরিকল্পনা একসঙ্গে জেনে গেলে তাঁর জন্য ভালো, ঠিক একইভাবে কাল নাজমুল হাসানও বলেছেন, ক্রিকেটাররা যদি আগেই জানিয়ে দেন কে কোন সিরিজে খেলবেন না, তাহলে তাঁদের পরিকল্পনা করতে সুবিধা হয়।

 

সাকিব অবশ্য এবার সেটা জানিয়েছিলেন, হয়তো কারণটা তখন ছিল আইপিএল। তবে এটাও তো হতে পারে আইপিএলের চিন্তা মাথায় ছিল বলেই দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের জন্য মানসিক প্রস্তুতিটা নেওয়া হয়নি তাঁর। আফগানিস্তান সিরিজের মধ্যেও হয়তো মনের মধ্যে জাগাতে পারেননি আগ্রহটা। শেষ পর্যন্ত দল ঘোষণার পরও তাঁর মনে হচ্ছে—না, এভাবে দলের সঙ্গে যাওয়া যায় না। সাকিবের বলা কারণটাই যদি ঠিক হয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁকে নিয়ে গিয়েও কি খুব লাভ হবে?

 

আর যদি বিসিবির সত্যিই মনে হয় সাকিব ঠিক বলছেন না, তাহলে আসল কারণটা খুঁজে বের করুক। কারণ সাকিব না হয় ছুটি চান, তাঁকে ছুটি তো শেষ পর্যন্ত বিসিবিই দেয়!